মাইশার ঠোঁটের কোণে পৈচাশিক হাসি নিরব শেখের হৃদ*স্প'ন্দন বাড়িয়ে তুলছে । সাড়া বাড়িতে রোহানের কোনো খোঁজ মিলে নি। মাইশা ততক্ষণে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। নিরব শেখ নিজেকে সামলিয়ে নেন। মাইশার চোখে চোখ রাখতে সাহস পাচ্ছেন না তিনি। এটা আদৌও মাইশা নাকী কোনো বহুরূপী কেউ। নানান চিন্তা নিরব শেখ কে ভাবিয়ে তুলেছে।
"_কী হলো আপনি এমন ভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?
মাইশার কথায় নিরব শেখের ঘোর কাটে। মেয়েটার মায়াবী চাহনি পাগল করে তুলে নিরব শেখ কে।
"_ হয়তো আমি কোথাও ভুল করেছি। মাইশা কে আমি যতটুকু জানি ও এমন জঘন্য কাজ করতেই পারে না। অনেক ভালোবাসে আমায় , তার সাথে শ্রদ্ধাও করে।
ভাবতে ভাবতে নিরব শেখ শার্টের হাতায় কপালে জমে থাকা ঘাম মুছে নেন। কিন্তু তার কাছে প্রশ্ন এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। যদি এটা সত্যিই মাইশা হয়, তবে যাকে হ'ত্যা করেছে সে আসলে কে?
এ কেমন ধাঁধায় পড়ে গেলেন তিনি। মাথাটা তার চিনচিন করছে ।
"_কী হলো আপনি ঠিক আছেন তো ? এমন করছেন কেনো?
স্নেহ কাতর কন্ঠ শুনে নিরব শেখের অন্তর কেঁপে উঠে । গত রাতে ভুল বসত নিজের ভাইকে হ'ত্যা করেছেন তিনি । এই দায় সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। দৌড়ে স্রোত ধারার কাছে ছুটে আসেন নিরব শেখ। এখানেই বস্তা বন্দি দুটি লা'শ ফেলে রেখে গেছেন গত রাতে। কিন্তু একি এখানে তো একটা বস্তা! বাকি আরেকটা বস্তা গেলো কোথায়?
সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। কোমরে হাত রেখে শেষ শক্তি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চেষ্টা করছেন নিরব শেখ।
"_ বউমা নিরব কই? রোহান কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এখন আবার নিরব কোথায় গেলো?
শাশুড়ির কথায় আমতা আমতা সুরে মাইশা জবাব দিলো "_আজ্ঞে মা ! উনি হয়তো রোহান কে খুঁজতে বেরিয়েছেন ।
মাইশার হাব ভাব বেশ সন্দেহ জনক। জুলেখা বেগম চোখ দেখেই বুঝে ফেলেন হয়তো তার ছেলের বউ তার থেকে কিছু লুকাচ্ছে ।
"_ মাইশা তুমি কী কিছু লুকাচ্ছো আমার থেকে?
শাশুড়ির সন্দেহভরা কন্ঠ মাইশা কে চমকিয়ে তুলছে।
"_না মা , আমি কী লুকাবো আপনার কাছ থেকে। তাছাড়া আমি তো মাত্রই ঘুম থেকে উঠে এসব শুনলাম।
জুলেখা বেগম ভ্রু কুঁচকে খানিক তাকিয়ে রইল মাইশার দিকে। জুলেখা বেগম আগে থেকেই মাইশাকে সহ্য করতে পারেন না। এমন একটা বংশ পরিচয় হীন রাস্তার মেয়ে অবশ্যই শেখ বংশের পুত্র বধু হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। তাই জুলেখা বেগম বরাবরই এই বিয়ের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু নিরবের তো একটাই কথা , সে মাইশা কে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। তাই এই এতিম মেয়েকে পুত্র বধু করে ঘরে তুলেছেন জুলেখা বেগম।
নিরব শেখের বাবার অকাল মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে শেখ পরিবারে । পুরো পরিবারের ভার নিরব শেখের কাঁধে এসে পড়ে। এইচএসসি শেষ করেই প্রবাস জীবনে পারি দেন তিনি। দীর্ঘ কয়েক বছর প্রবাস জীবন পার করে ছুটি কাটাতে দেশে ফিরেন তিনি । তখনই হঠাৎ একদিন মাইশার সাথে একটা মাজারের সামনে পরিচয় হয় নিরবের। মেয়েটা গরীব এতিম বাচ্চাদের জন্য দান বক্স হাতে টাকা উঠাচ্ছে । মেয়েটার মায়াবী চাহনি বেশ মায়া লাগিয়ে দেওয়ার মত। নিরব বেশ খানিকক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন মেয়েটার দিকে।
"_ আসসালামুয়ালাইকুম। জ্বী আমরা পাশেই একটা এতিম খানা থেকে এসেছি। এতিম বাচ্চাদের জন্য টাকা উঠাচ্ছি যদি কিছু দিতেন তাদের জন্য।
মেয়েটার কন্ঠেও বেশ জাদু আছে বলতেই হবে। নিমিষেই নিরব শেখের মন ছুঁয়ে দিয়েছে। তার যেনো চোখের পলক ফেলতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে সারাদিন এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে।
"_এই যে স্যার!
মাইশার পুনরায় ডাকে ঘোর কাটে নিরব শেখের।
"_জ্বী আমি বড় কিছু দান করতে চাই। তার জন্য আপনাকে আমার ঠিকানায় আসতে হবে।
নিরব শেখের কথায় মাইশা রাজি হয়ে যায়। একটা চিরকুটে ঠিকানা লিখে হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিরব শেখ চলে আসেন । মাইশা পরদিন সেই ঠিকানায় দেখা করে তার সাথে। কিন্তু এটা তো কোনো কফি শপের ঠিকানা বলে মনে হচ্ছে। তাছাড়া দেখা করার সময়ও দেওয়া আছে সেখানে।
"_জ্বী স্যার আমি আপনার ঠিকানায় এসেছি। এখন বলেন কী দিতে চান আপনি?
নিরব খানিক মুচকি হেসে মাইশা কে চেয়ারে বসতে বলেন। মাইশা অগত্যা চেয়ার টেনে বসে পড়ে।
"_আসলে আমি আপনাকে কিছু বলতে চাচ্ছি ।
নিরব শেখের কথা শুনে মাইশা হকচকিয়ে গেল।কী এমন বলতে চায় এই অপরিচিত লোকটা, যার জন্য এতদূরে নিয়ে আসলো তাকে।
"_জ্বী বলেন কী বলতে চান?
নিরব শেখ খানিক সময় নিয়ে চোখ বন্ধ করে বলতে শুরু করেন ।
"_আসলে আমি আপনাকে প্রথম দিন দেখেই ভালোবেসে ফেলেছি । আমি প্রেম ভালোবাসায় বিশ্বাসী নই । তাই আপনাকে ইসলামিক নিয়ম অনুযায়ী বিয়ে করতে চাই। আপনি কি রাজি আছেন?
কথা গুলো একদমে বলে শেষ করে নিরব শেখ বড় করে ঢোক গেলেন। উত্তরের আশায় অস্থির হয়ে আছেন তিনি।
"_আপনার সাথে আমার ভালো ভাবে পরিচয়টাও হয়নি। আর আপনি কিনা আমাকে বিয়ে করতে চান?
সেদিন রাগান্বিত হয়ে মুখ ফিরিয়ে চলে যাওয়া মেয়েটাই আজ নিরব শেখের বিয়ে করা বউ।
পুরোনো স্মৃতি গুলো বার বার মনে পড়ছে নিরব শেখের। রোহানের বস্তা বন্দি লা'শ সামনে নিয়ে নদীর পাড়ে এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।
হঠাৎ কারো ধাক্কায় নিরব শেখের ঘোর কাটে। পেছনে তাকিয়ে দেখে বন্ধু আরমান দাঁড়িয়ে আছে।
"_কিরে তোরে সারা এলাকা খুঁজে মরছি আর তুই এখানে ? আন্টি তোকে আর রোহান কে খুঁজছে খুঁজতে পাগল হয়ে গেছেন।
নিরব নির্বাক হয়ে আরমানের দিকে তাকিয়ে আছেন।
আরমান খেয়াল করে সামনে একটা র'ক্ত মাখা বস্তা পড়ে আছে। বেশ আগ্রহ নিয়ে আরমান বস্তাটির দিকে তাকিয়ে রইল।
"_ ভাই এই বস্তা তে কী আছে?
নিরব শেখ বেশ ঘাবড়ে গেছেন। কোনো মতে যদি আরমান বুঝতে পারে বস্তায় রোহানের লা'শ আছে, তাহলে সে ফেঁসে যাবে।
"_ কই বস্তা তে কিছু নেই তো।
আমতা আমতা কন্ঠে বলতে থাকেন নিরব শেখ। আরমান ধীর পায়ে বস্তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। নিরব শেখ বাঁধা দিতে চেয়েও ব্যর্থ হলেন। বস্তার মুখ খুলতেই চিৎকার দিয়ে উঠে আরমান । রোহানের লা'শ পুরো র'ক্তে লাল বর্ণ ধারণ করেছে।
"_ তুই নিজের ভাইকে মেরে দিয়েছিস? তুই মেরেছিস রোহান কে।
নিরব শেখের কলার চেপে ধরে ঝাকাতে থাকে আরমান। নিরব নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে আরমান কে ধাক্কা মারে। প্রচন্ড ধাক্কায় আরমান স্রোত ধারায় পড়ে যায়। নিরব শেখ বুঝতে পারে পুনরায় খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে। নদীর স্রোত বেশ জোরালো। কয়েক সেকেন্ডে আরমান কে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। নিরব শেখের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট ভেসে উঠেছে। নিজ প্রান প্রিয় বন্ধুকেও ছাড়লো না সে।
নিরব শেখ দ্রুত পদক্ষেপে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন । কি হচ্ছে এসব তাঁর সাথে, আর কেনোই বা হচ্ছে?
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, হালকা কুয়াশায় চারপাশটা ভালো মত দেখা যাচ্ছে না। ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করেন নিরব শেখ। খানিক পর পর দীর্ঘ শ্বাস ফেলছেন তিনি। চোখের কোণে পানি জমে আছে।
"_কী হলো এত তাড়াতাড়িই হাঁপিয়ে গেলেন?
ভারী কন্ঠস্বর শুনে পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখেন মাইশা চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মাইশার খোলা চুল গুলো আকাশে এলোমেলো ভাবে উড়ছে । কন্ঠটাও কেমন ভারী হয়ে উঠেছে।
"_ কে , কে তুমি? আমি জানি তুমি আমার মাইশা হতেই পারো না। সত্যি করে বলো কে তুমি? আর কেনো করছো এসব?
নিরব শেখের কথা শুনে মাইশা বিরক্তিকর হাসি হেসে তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
"_ যদি বলি আমি কোনো দিন মাইশা ছিলামই না! তখন কী করবেন আপনি?
মাইশার কথায় রহস্য লুকিয়ে আছে। নিরব শেখ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
"_ মানে কী বলতে চাচ্ছো তুমি?
বড় করে দম নিয়ে নিরব শেখ প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে মাইশার মুখ পানে তাকিয়ে আছেন ।
"_সে সময় হলে ঠিক জানতে পারবেন মিঃ আরিফ, ওহ সরি মিঃ ,,, নিরব শেখ।
মাইশার মুখে আরিফ ডাক শুনে ঘাবড়ে গেছেন নিরব শেখ। সারা শরীর ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ভিতরে কেমন অস্থিরতা কাজ করছে। কাঁপা কাঁপা গলায় পুনরায় জিজ্ঞেস করেন ।
"_ সত্যি করে বলো তুমি কে ?
মাইশা বিকট শব্দে হেসে উঠে ।
"_ আমার আসল পরিচয় জানার আগে নিজের মায়ের কথা ভাবুন। কারন তার দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে।
পুনরায় অট্রো হাসিতে মেতে উঠেছে মাইশা। অন্ধকার বাড়িটা দ্বী গুন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।
লেখকঃ আরিফ ইসলাম (সংগৃহীত)
0 Comments:
Note: Only a member of this blog may post a comment.