১৯৯৫ সালের এক বসন্তের দুপুর। ধানমণ্ডির একটি ছোট প্রাইভেট কলেজে একটি সাহিত্য সেমিনার চলছে। হলরুমে নিরবতা, মাঝে মাঝে কিছু কাশির শব্দ। মঞ্চে দাঁড়িয়ে রয়েছেন নাবিলা রহমান, ইংরেজি বিভাগের শিক্ষিকা। তার কণ্ঠে একধরনের আত্মবিশ্বাস, একধরনের ক্লান্তি। তার বয়স ত্রিশ, কিন্তু চোখে যেন শতাব্দীর ক্লান্তি।
নাবিলা যেন হেঁটে আসছেন কোনো দুঃখগাঁথার পাতা থেকে। তার পরনে সাদা-মেরুন মিশ্র শাড়ি, খোঁপায় গোঁজা একটি কাঁচা ফুল। গলার নিচে হালকা কাজের ব্লাউজ তার গঠনকে নান্দনিকতা দেয়। তার চলাফেরায় ছিল এক ধরনের আভিজাত্য, চোখে-মুখে পরিণত নারীত্বের ছাপ—যা শুধু বয়স নয়, অভিজ্ঞতা আর সংবেদনশীলতার পরিচয় দেয়।
তার ত্বক যেন সন্ধ্যার শেষ আলোতে রূপালী হয়ে ওঠে, কোমল অথচ আকর্ষণীয়। শরীরের বাঁকগুলো শাড়ির মোচড়ে হয়ে ওঠে শিল্পীর তুলির টানে আঁকা এক নিখুঁত ক্যানভাস। তার গলার হালকা খাঁজ, কপালের টিপ, আর ঠোঁটের কোণে লুকিয়ে থাকা নিঃশব্দ হাসি—সবকিছু মিলে যেন এক রহস্যময় কবিতা। রোদে পড়া গালে লালচে আভা, চোখের নিচে হালকা ক্লান্তির রেখা—তবুও এক অমোঘ টান। যেন কোনো হারিয়ে যাওয়া গল্পের এক জীবন্ত চরিত্র।
হলরুমের শেষ সারিতে বসে আছে তানভীর। সদ্য এইচএসসি পাস করেছে, নতুন নতুন কবিতা লিখছে, মন জুড়ে আগুনের মতো কিছু আবেগ। তার চোখ আটকে গেছে একদৃষ্টে নাবিলার ওপর। কথার ভেতর সে যেন সুর খুঁজে পায়, চুলে ছোঁয়া দেওয়া রোদে সে খুঁজে পায় এক ধরনের আলো।
তানভীর বুঝতে পারে, এই নারী শুধু একজন শিক্ষক নন, এক যাদুকরী। তার শরীরী ভাষা, তার চোখের দৃষ্টি, তার অন্যমনস্ক হাসি—সবকিছু মিলে একটি পূর্ণাঙ্গ কাব্যের মতো। নাবিলার বুকের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া শাড়ির আঁচল তার নজরে এসে আটকে যায় বারবার। সে ভাবে, কী অপার্থিবভাবে এক নারী নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারে, অথচ নিজের অজান্তেই ছড়িয়ে দিতে পারে ভালোবাসার বীজ।
তারা কথা বলেনি। কিন্তু চোখে চোখ একবার ধরা পড়েছিল। নীরব ভাষায় এক টুকরো ভাব প্রকাশ পেয়েছিল। সে দিনই যেন তানভীর জানল—এই নারী একদিন তার জীবনের গল্পে থাকবে।
অধ্যায় ২:
তানভীর জানতে পারে, নাবিলা তার ভাইয়ের কলেজে অতিথি শিক্ষিকা হিসেবে ক্লাস নিচ্ছেন। একদিন সাহস করে ভাইয়ের নাম করে সে দেখা করতে আসে। বই পড়ার অজুহাতে নাবিলার কাছে ইংরেজি শেখার আগ্রহ দেখায়।
নাবিলা প্রথমে বিস্মিত হয়। সে বুঝতে পারে এই ছেলেটি কিছুটা আলাদা। চোখে সাহস, কথায় কবিতা। নাবিলা প্রথমে গম্ভীর, দূরত্ব রেখে চলে। তানভীর ধীরে ধীরে তার হৃদয়ে প্রবেশ করে—নিরব, ধৈর্যশীলভাবে।
একদিন বিকেলে, বারান্দায় রোদ পড়ে রয়েছে। নাবিলা চা হাতে বসে আছে, আর তানভীর আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে তার দিকে। তার চোখে তখন এক অদ্ভুত সাহস, যেন অনেকদিনের জমে থাকা কথা এখনই উগরে দেবে।
হঠাৎ সে বলে বসে, “আপনি জানেন, এই রোদের মতোই আপনি—আলো দেন, কিন্তু ছুঁতে দেন না।”
নাবিলা মৃদু হেসে বলে, “এত রূপক দিয়ে কথা বললে তো জীবনে বাস্তবতা বুঝবে না।”
তানভীর থামে না, এবার তার কণ্ঠে গভীর আবেগ: “আপনার হাসি আমার দিন শুরু করে। আপনার ভ্রু কুঁচকে তাকানো, আপনার ক্লান্ত চোখের জল, সবকিছু আমি দেখতে চাই—আপনার পাশে থেকে। আমি চাই, আপনি আমার দিন শুরু করুন, রাত শেষ করুন।”
তার চোখ যেন কিছু বলতে চায়—অভিমানের ভাষায়, প্রেমের নির্ভরতায়। “আমি জানি, আমার বয়স কম, সমাজ হাসবে, আপনি ভয় পাবেন। কিন্তু ভালোবাসা কি ক্যালেন্ডার দেখে হয়? আমি আপনাকে ভালোবাসি। সেই ভালোবাসায় ভয় নেই, লজ্জা নেই, কেবল নির্ভরতা আছে।”
নাবিলা হতভম্ব, তার চোখে অপ্রস্তুত বিস্ময়। “তুমি কি জানো তুমি কী বলছো?”
“আমি জানি,” তানভীর ধীরে বলে, “আমি তোমাকে ভালোবাসি। আপনি যদি না চান, আমি সরে যাবো। কিন্তু যদি কখনো একটুখানি জায়গা দেন হৃদয়ে, আমি সেখানে ঘর বাঁধতে চাই।”
নাবিলা চুপ করে থাকে। বাতাসে রোদের ঘ্রাণ, চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে। তার মনে হয়, অনেকদিন পর কেউ তার দিকে এমন করে তাকিয়েছে—কেবল নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে। তার বুকের ভেতরে কিছু যেন কাঁপে, বুকের নিচে জমে থাকা এক নিঃশ্বাস হঠাৎ বেরিয়ে যায়।
সে কিছু বলে না, কিন্তু তার চোখের ভাষা বলে দেয়—এই প্রপোজাল তাকে ছুঁয়ে গেছে। সে জানে না, উত্তর কী হবে। কিন্তু এই বিকেল, এই রোদ, এই বারান্দা, আর তানভীরের কণ্ঠে যে কম্পন—তা তার হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায় চিরকালের মতো।
অধ্যায় ৩:
ঢাকার রাস্তাগুলো যেন বদলে গেছে। সেই চেনা রাস্তায় এখন এক অচেনা উত্তেজনা, এক কেমন অনুভূতির দোলা। কলেজ শেষে হেঁটে ফেরার পথে তানভীর মাঝে মাঝে অপেক্ষা করে পথের মোড়ে, শুধু একঝলক নাবিলাকে দেখার আশায়। মাঝে মাঝে দুইজনের হঠাৎ দেখা হয়ে যায় ধানমণ্ডি লেকের ধারে, পুরোনো বইয়ের দোকানে, কিংবা রিকশার গলিতে। কথা না হলেও চোখে চোখে চলে এক গভীর সংলাপ।
একদিন সন্ধ্যায়, পুরান ঢাকার এক বইমেলায় দেখা হয়। ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ করেই তানভীর নাবিলার পাশে এসে দাঁড়ায়। সে হাতে তুলে দেয় একটি পুরোনো রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থ। বইয়ের ভেতরে একটি ছোট চিরকুট—“এই শহরে অনেক কিছুই পুরনো হয়ে যায়, শুধু ভালোবাসা নয়।”
নাবিলা হতবাক। তার চোখে জল এসে পড়ে। সে বইটি হাতে নেয়, কিছু বলে না। এরপর হেঁটে চলে যায়, কিন্তু তানভীর দেখে তার কাঁধটা একটু কাঁপছে।
সেই রাতেই, বৃষ্টি নামে। নাবিলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে, একা। তার মনে পড়ে তানভীরের কণ্ঠ, তার কবিতা, তার সরল চোখের দৃষ্টি। বয়সের ব্যবধান কি সত্যিই এত বড় দেয়াল? তার ভেতরে এক দ্বন্দ্ব, কিন্তু একইসাথে এক উত্তাপও।
এক সন্ধ্যায়, নাবিলা হঠাৎ একা গিয়ে দাঁড়ায় সেই পুরোনো বইয়ের দোকানের সামনে। আচমকা, পেছন থেকে একটি কণ্ঠস্বর—“আজও কি রবীন্দ্রনাথের কবিতা খুঁজছেন?” নাবিলা ঘুরে দেখে তানভীর। মুখে সেই চিরচেনা হাসি, কিন্তু চোখে এক অন্যরকম পরিণততা। তারা একসাথে হাঁটতে থাকে, ধীরে ধীরে।
চায়ের দোকানে বসে দু’জনে কথায় কথায় হারিয়ে যায়। তানভীর বলে, “আপনি জানেন, এই শহরের প্রতিটি গলিতে আমি আপনাকে খুঁজেছি।” নাবিলা হেসে বলে, “আর আমি চেষ্টা করেছি ভুলে যেতে।”
তানভীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “ভুলে যাওয়া মানেই কি ভালোবাসা থেমে যায়?”
নাবিলা আর কোনো উত্তর দিতে পারে না। শুধু চুপচাপ তাকিয়ে থাকে তার দিকে। সেই চোখে সে দেখে একটি নতুন পৃথিবী, যেখানে বয়স নয়, মনই মুখ্য।
অধ্যায় ৪:
তানভীর হাল ছাড়ে না। সে প্রতিদিন একটি করে চিঠি লেখে—কখনো কবিতার মতো, কখনো গল্পের মতো। কিন্তু দেয় না। সে জানে নাবিলা পড়বে না। তবুও লেখে। প্রতিটি চিঠিতে থাকে তার না বলা অনুভূতির প্রতিচ্ছবি। যেন এক আশ্চর্য ডায়েরি, যা কেবল তারই জন্য বরাদ্দ।
এদিকে নাবিলার মনেও একধরনের সাড়া তৈরি হয়। সে তানভীরকে দূরে ঠেলে দিলেও নিজের ভেতর তার জায়গা তৈরি হতে থাকে। কিন্তু সে স্বীকার করতে ভয় পায়। বয়সের ব্যবধান, সমাজের চোখ, পরিবার—সবকিছু মিলিয়ে একধরনের অপরাধবোধ কাজ করে তার ভেতরে।
একদিন, কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে দেখে, তানভীর চুপচাপ বসে একটি কবিতা লিখছে। তার কণ্ঠে নেই কোনো অভিমান, শুধু ধৈর্য। সেই দিন, নাবিলা প্রথমবার নিজেকে প্রশ্ন করে—এই ছেলে কি তাকে সত্যিই ভালোবাসে?
এরপর এক রাতে, নাবিলা তার নিজের ডেস্কে একটি চিঠি খুঁজে পায়। কোনো প্রাপক বা প্রেরকের নাম নেই। তবুও হাতের লেখা চেনা। তানভীরের লেখা—"তুমি হয়তো ভাবছো, আমার ভালোবাসা কেবল একতরফা। কিন্তু এই চিঠিগুলো আমার নিঃশ্বাস। যেদিন তুমি সত্যি করে একটাও পড়বে, সেদিন আমি আমার ভেতরের মানুষটা তোমার কাছে খুলে ধরব।"
নাবিলা সেই রাতেই একটি একটি করে চিঠি পড়তে শুরু করে। প্রথমে অভিমানে, পরে কৌতূহলে, আর শেষে ভালোবাসায়। প্রতিটি চিঠির ভাঁজে সে খুঁজে পায় নিজেরই প্রতিচ্ছবি। তানভীর তাকে শুধু ভালোবাসেনি, জেনেছে—তার নিঃশ্বাসে, দোলায়, ভয় ও স্বপ্নে।
রাতে, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে মনে মনে বলে, “তোমার এই অলিখিত চিঠিগুলোই আমার জীবনের সবচাইতে সুন্দর প্রেমপত্র।”
অধ্যায় ৫:
হঠাৎ একদিন, অতীতের ছায়া ফিরে আসে। নাবিলার পুরনো প্রেমিক, রাকিব—যে একসময় তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল বিদেশে, ফিরে এসেছে। সে ক্ষমা চায়, নতুন করে শুরু করতে চায়।
নাবিলা দ্বিধায় পড়ে যায়। রাকিব একসময় তার পৃথিবী ছিল। কিন্তু সেই রাকিবই তাকে ভেঙে দিয়েছিল। এখন, তানভীর তাকে গড়তে চায়। কিন্তু তানভীর তো আরও ছোট, অচেনা ভবিষ্যত।
তানভীর জানে রাকিব ফিরেছে। সে কিছু বলে না। শুধু বলে, “তুমি যা ঠিক মনে করো, তাই করো। আমি অপেক্ষা করতে জানি।”
অধ্যায় ৬:
নাবিলা একদিন চিঠিগুলো খুঁজে পায়। তানভীরের বন্ধু তাকে দিয়ে দেয় সেগুলো। প্রতিটি চিঠিতে একধরনের প্রেম, ত্যাগ আর একাগ্রতা লেখা।
একটি চিঠিতে লেখা ছিল—“যদি এই শহরের রাস্তায় কোনোদিন আমাকে ভুলে যাও, তবুও আমি জানব, আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম নীলপদ্মের ছায়ায় দাঁড়িয়ে।”
নাবিলা বুঝতে পারে—ভালোবাসা মানে বয়স নয়, মানে সাহস। সে সিদ্ধান্ত নেয়, রাকিব নয়, সে চাই তানভীরকে। কিন্তু তখন সে শোনে—তানভীর স্কলারশিপ পেয়ে কানাডায় যাচ্ছে, আজই রাতের ফ্লাইট।
অধ্যায় ৭:
ঢাকা শহরে বৃষ্টি নামছে। ছায়ানটের গলিতে ছায়া ভেজা। নাবিলা ছুটে যায় বিমানবন্দরের দিকে। তানভীর তখন চেক-ইন করে ফেলেছে। কিন্তু যাওয়ার আগে সে কলেজে গিয়ে একটি খাম রেখে গেছে—সেই খামে তার শেষ চিঠি।
নাবিলা সেই চিঠি হাতে পায়। সেখানে লেখা—“তোমার সাহস যদি কোনোদিন জেগে ওঠে, আমাকে খুঁজে নিও। আমি থেমে থাকব, হয়তো এই শহরের বাইরে, কিন্তু ভালোবাসার ভেতরে।”
নাবিলা বিমর্ষ হয়ে যায়। কিন্তু সে হাল ছাড়ে না। সে সিদ্ধান্ত নেয়, সে তানভীরকে খুঁজবে—যেভাবেই হোক।
অধ্যায় ৮:
২০০০ সালের জানুয়ারি। তানভীর এখন মন্ট্রিয়ালে লেখাপড়া করছে। সে একটি সাহিত্য ম্যাগাজিনে একটি গল্প পাঠায়—"নীলপদ্মের ছায়া"। পাঠকের প্রতিক্রিয়া অসাধারণ। একদিন একটি ইমেইল আসে—"এই গল্প আমার গল্প, যদি তুমি নাবিলা হয়ে থাকো, তাহলে আমি তানভীর।"
তানভীর হতবাক। সে জানে, এ চিঠি কেবল একজনই লিখতে পারে।
সে রাতেই ঘুম হয় না। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে নাবিলার হাসি, সেই কলেজের মঞ্চ, সেই রবীন্দ্রসংগীত। দুই সপ্তাহ পর, এক শীতের রাতে সে বিমানে চড়ে বসে। জানালার বাইরে তুষারপাত আর ভেতরে হৃদয়ে এক তীব্র অপেক্ষা।
ঢাকায় নামার পর, সে সোজা চলে যায় পুরোনো ধানমণ্ডির সেই বইয়ের দোকানে। দোকানটি এখনো আছে—একটু পুরনো, কিন্তু চেনা গন্ধে ভরা। বইয়ের তাক ঘেঁটে সে পায় একটি চিরকুট—“আমি ফিরে এসেছি। তুমি আসবে তো?”
হৃদয় দৌড়াতে শুরু করে। ঠিক তখনই পেছন থেকে এক কণ্ঠস্বর, “নীলপদ্মের ছায়া... আজও খুঁজে ফিরো?”
সে ফিরে তাকায়। নাবিলা দাঁড়িয়ে আছে, নীল শাড়িতে, হাতে পুরোনো একটি খাম। চোখে জল, ঠোঁটে হাসি।
তানভীর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, বলে, “তুমি আসবে বলেছিলে, তাই তো আমি থেমে ছিলাম।”
নাবিলা তার হাত ধরে, চেপে ধরে বুকের সাথে। তারা বোঝে, প্রেম কখনো মরে না—সে ঘুমায়, আবার জেগে ওঠে। ঠিক যেন নীলপদ্মের মতো—দুষ্প্রাপ্য, তবুও চিরন্তন।
অধ্যায় ৯:
ধানমণ্ডির পুরোনো এক বইয়ের দোকানে এক বিকেলে দেখা হয় দুজনের। নাবিলা এক হাতে ধরে রাখে একটি চিঠি, আরেক হাতে তানভীরের হাত।
তানভীর হাতে তুলে দেয় একটি বই—"নীলপদ্মের ছায়া"। বইয়ের ভেতরে লেখা—"এই গল্প কারো নয়, এই গল্প আমাদের... আর আজ থেকে এটা আমাদের জীবন।"
তারা বইয়ের দোকান থেকে বেরিয়ে হাঁটে ধানমণ্ডি লেকের দিকে। সূর্য তখন অস্ত যেতে শুরু করেছে। হালকা শীতের বাতাসে নাবিলা তার কাঁধে চাদর জড়িয়ে নেয়। তানভীর সেই চাদরের নিচে হাত রাখে, একসাথে হাঁটে নীরবে।
লেকের পাশে বসে তারা দুই কাপ চা খায়। তানভীর নাবিলার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি জানো, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না তুমি এখানে।”
নাবিলা হেসে বলে, “আমি জানি, আমি দেরি করেছি। কিন্তু ভালোবাসা তো কখনো সত্যিই দেরি করে না।”
তারা কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকে। তারপর তানভীর হঠাৎ করে তার হাত ধরে বলে, “চলো না, আমরা আরেকটা শুরু করি। নতুন করে, আমাদের মতো করে।”
নাবিলা বলে, “শুরু তো অনেক আগেই হয়েছিল। আজ শুধু সেটা জীবন হয়ে উঠুক।”
সেই সন্ধ্যায়, তারা রিকশায় ঘোরে পুরান ঢাকার অলিগলি। পুরোনো সিনেমার মতো দৃশ্য—ঝিমঝিম বাতি, ভেজা পিচরাস্তা, আর দুটি মুখে অপূর্ব শান্তি। একটি পুরোনো ছাদবাগানে দাঁড়িয়ে তারা চাঁদ দেখে, হাত ধরাধরি করে, আর প্রতিজ্ঞা করে—এই পথ চলা কখনো থামবে না।
শেষ অধ্যায়:
সেই দিন, তারা বিয়ে করে। ছোট পরিসরে, কাছের কিছু মানুষকে নিয়ে। না ছিল বড় আয়োজন, না ছিল প্যান্ডেল। ছিল শুধু ভালোবাসা, সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি হৃদয়।
রাত্রি নামে ধীরে ধীরে। নতুন সাজানো ঘরে, মৃদু আলোয়, মশারির ভেতর বসে নাবিলা ধীরে ধীরে পর্দা সরিয়ে তানভীরের মুখের দিকে তাকায়। চোখে জল টলমল, ঠোঁটে আলতো হাসি।
নাবিলা (নরম কণ্ঠে): “তুমি জানো, আজ আমার প্রথম রাত নয়... কিন্তু এই প্রথম আমি নিজেকে কারো সামনে এতটা নির্ভয়ে, এতটা ভালোবেসে তুলে দিলাম।”
তানভীর (তার হাত ধরে): “তুমি আমার গল্পের শুরু ছিলে, আজ থেকে তুমি আমার জীবন। তোমার প্রতিটি হাসি, প্রতিটি নিঃশ্বাস আমি আগলে রাখতে চাই।”
তারা একে অপরের দিকে এগিয়ে আসে, ধীরে ধীরে। বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ, জানালার পর্দা হালকা দুলছে। তানভীর আলতো করে নাবিলার কপালে চুমু খায়, তারপর চোখে, গালে, ঠোঁটে। প্রতিটি ছোঁয়ায় ছিল ভালোবাসার সাহস, ভক্তি আর নির্ভরতার ছায়া।
তানভীর তার আঙুল দিয়ে নাবিলার মুখ ছুঁয়ে দেয়, ধীরে ধীরে। নাবিলা কেঁপে ওঠে, চোখ বন্ধ করে দেয়। তানভীর তার গলায় ঠোঁট ছোঁয়ায়, হাত বুলিয়ে নেয় তার বাহু বেয়ে। নাবিলা ধীরে তানভীরের বুকের উপর হাত রাখে, তার হৃদয়ের শব্দ শুনতে চায়।
তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে, যেন সময় থেমে গেছে। প্রতিটি স্পর্শ, প্রতিটি চুম্বন ছিল ভালোবাসার ভাষা। কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না, ছিল গভীর আবিষ্কারের নীরব আনন্দ। মশারির ছায়ার আড়ালে, শরীর আর আত্মা মিলেমিশে এক নতুন অধ্যায় লেখে। নাবিলার চুল খুলে পড়ে কাঁধে, তানভীর তার ঘাড়ে ঠোঁট রাখে, আর কেঁপে ওঠে সময়।
তানভীর ফিসফিস করে বলে, “এই হৃদয় শুধু তোমার। চিরদিনের জন্য।”
তারা একে অপরের মধ্যে হারিয়ে যায়—দেহে নয়, আত্মায়। তাদের ভালোবাসা ছিল নীরব, গভীর, পূর্ণ। শরীর সেখানে শুধুই বাহন, আত্মার এক অবিচ্ছেদ্য মিলনের জন্য।
নাবিলা ফিসফিস করে বলে, “তুমি আমার সাহস, তুমি আমার সমস্ত ভয় কাটিয়ে ওঠা। আমি তোমার মাঝে নিজেকে খুঁজে পেয়েছি।”
তানভীর বলে, “তুমি আমার স্বপ্ন নয়, তুমি আমার বাস্তব।”
সেই রাতে তারা শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা ছিল না, ছিল দুটি আত্মা, যারা শত বাঁধা, ভয়, সমাজের চোখ উপেক্ষা করে এক হয়। তারা নতুন জীবনের সূচনা করে, যেখানে শরীরের ঊর্ধ্বে উঠে এক গভীর আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়।
ঘরের বাইরে তখনো হালকা বৃষ্টি, শিউলির গন্ধে ভেসে আসে স্মৃতির পথ। আর ঘরের ভেতরে একজোড়া প্রেমময় চোখে শুরু হয় নতুন অধ্যায়ের লেখা—যেখানে কেবল ভালোবাসাই মুখ্য, চিরন্তন, নিঃশর্ত।
(সমাপ্ত)
নীলপদ্মের ছায়া
ধ্রুব চৌধুরী
সময়কাল: ১৯৯৫-২০০০
0 Comments:
Note: Only a member of this blog may post a comment.