Friday, May 2, 2025

নারীবাদীদের নারীবাদ - আকিব শিকদার | Naribadider Naribad

 “আফামনি, ও আফামণি... আফনে তো লেহক মানুষ, মাথায় অনেক জ্ঞান। আসমানে যত তারা, দুনিয়াতে যত গাছ, সাগরেতে যত মাছ, তার চাইতেও অনেক বেশি জ্ঞান আফনের। আচ্ছা, একটা কথা জিগাই? জবাব দিবার ফারবেন? একটা পোলায় যদি একটা মাইয়ারে ধইরা ফালায়, তয় মাইয়াডার চরিত্র নষ্ট হয়, সতীত্ব নষ্ট হয়, কিন্তু পোলাডার কিছুই হয় না! আচ্ছা, বলবার ফারবেন পোলাডার চরিত্র কখন নষ্ট অয়? পোলাডার সৎগিরি কহন নষ্ট অয়? কিংবা পোলাডার চরিত্র, সৎগিরি নষ্ট অয় না কেন?”

নারীবাদীদের নারীবাদ - আকিব শিকদার | Naribadider Naribad


 কাজের মেয়ে রেবিনার প্রশ্ন শুনে সংবাদপত্রের পাতা থেকে চোখ তুললেন বিশিষ্ট সমাজ সেবিকা,

স্বাধীন সংগ্রামী মহিলা সমিতির সংঘটক, নারীবাদী লেখিকা শাহরিয়ার পারভীন বিপ্লবী।

আটচল্লিশ বছরের জীবনের প্রায় পচিশ বছর ধরে এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে পেতে মরিয়া হয়ে আছেন

শাহরিয়ার পারভীন। জবাব আজও খুঁজে পাননি। তবে এই ফাঁকে স্বামী সংসার যৌবন সবই গেছে

তার। যাক, আফসোস নেই, তবু নারী স্বাধীনতার আন্দোলন টিকে থাক, এই যেন পণ। স্বামী সন্তান

সংসার এসব দিয়ে কে কী করেছে!

শাহরিয়ার পারভীন নামটা জন্মসূত্রে পিতৃদত্ব, সাথে বিপ্লবী শব্দটা নাম নয়, পদবী। নারী আন্দোলনে

বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে মহিলা সমিতির সদস্যরা দিয়েছে। তিনি ভারী

কাঁচের পাওয়ারী চশমাটা নাকের ডগা থেকে চোখের দিকে ঠেলে দিয়ে টেবিলের উপর থেকে গরম চা

ভর্তি চায়ের কাপটা ঠোঁটের কাছে তুলে নিলেন দ্বিতীয় চুমুক দেওয়ার জন্য।

“কই! আফামনি, জবাব দিলেন না যে! তয় আমার কী মনে হয় জানেন? যার মাথা আছে তারই মাথা

ব্যাথা অয়, যার জীবন আছে তারই মরণ অয়। যার মাথা নাই, তার ব্যথাও নাই; যার জীবন নাই, তার মরন হইব

কইনতে! আসলে পোলাগোর চরিত্রই নাই, এই কারণেই হেগর চরিত্র নষ্ট হওয়ার চিন্তাও নাই। ঠিক কই নাই

আফামনি?”

নারী নেত্রী শারিয়ার পারভীন বিপ্লবী তার কাজের মেয়ে রেবিনার কথা বলার ধরন দেখে খুশি হলেন। হাসতে

গিয়ে ঠোঁটের কাছ থেকে চায়ের কাপ অকস্মাৎ সরিয়ে নেওয়ায় অসতর্কতা বসত কাপ উপচে কয়েক

ফোটা চা সংবাদপত্রের পাতায় গড়িয়ে পড়ল। একজন নারী আন্দোলনকারী নেত্রীর কাজের মেয়ে যদি পুরুষ

সমাজকে অপমান সূচক নাকানি চুবানি দিয়ে কথা বলতেই না পারবে, তবে তার সে বাসায় কাজ

করার সার্থকতা কী রইল!

“এক দিক থেকে ভাবতে গেলে অবশ্য তুই ঠিকই বলেছিস। এই যে ওদের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে এত

লেখালেখি করি, জনসভায় মাইক ফাটিয়ে বক্তৃতা দেই, বঞ্চিত নারীদের নিয়ে রাজপথে মিছিল করি, ওদের

কোন পরিবর্তন হয়েছে কি! হয়নি। গন্ডারের চামড়ায় গুলি বিঁধে না। আমাদের কথার প্রতিবাদী তীর

ওদের মানসিকতায় বাধা পেয়ে ফিরে আসে। আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর, দেখবি এই নির্লজ্জ গন্ডারদের

শায়েস্তা করার মতো পদ্ধতি ঠিকই খুঁজে পেয়ে যাব আমরা।”

নব্বই ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে স্থাপিত সোফার যে দিকটায় শাহরিয়ার পারভীন বসেছেন, তার বিপরীত

দিকের সোফায় রেবিনার অবস্থান। আপামনির আশ্বাস বাণী শুনে রেবিনার মুখে একটা তৃপ্তির হাসি

খেলে গেল। হাসতে হাসতেই সংবাদপত্রের খেলার পাতাটা চোখের সামনে তুলে ধরল সে। লেখাপড়া জানা

একজন নারী হয়েও যদি অন্তত সারা বিশ্বের খেলার খবরটাই না জানা গেল, তবে শিক্ষিত নারীর শিক্ষার

সাফল্য অর্ধেকাংশই অসার্থক থেকে যায়।

শাহরিয়ার পারভীন বললেন, “খেলার পাতা নয়, খেলার পাতা নয়, শেষের পাতাটা পড়ে দেখ কী লিখেছে।”

রেবিনা খেলার পাতাটা টেবিলের উপর ভাজ করে রেখে দিয়ে শেষ পৃষ্ঠার খবরটা পড়ার জন্য গলা উঁচু করল।

সেখানে ছবিতে একটা পুরুষের গলা কাটা রক্তাক্ত লাশ ছাপানো হয়েছে। পড়ার আগ্রহ মুহূর্তেই শত

গুণ বেড়ে গেল।

যে লোকটার ছবি ছাপানো হয়েছে, তার ছিল দুইজন স্ত্রী। দুই স্ত্রী থাকার নেপথ্য কারণ শারীরিক নয়,

আর্থিক। স্ত্রীরা মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করে এনে লোকটার ভরণ পোষণ চালাতো; সংসার

চালাতো। মোটা অংকের যৌতুক নিয়ে বিয়ে করেছিলেন। সংসারের অভাব দেখা দিলেই বউদের

পাশবিকভাবে পিটিয়ে বাপের বাড়িতে পাঠাতেন আরও কিছু অর্থ প্রাপ্তির আশায়। খালি হাতে ফেরত


এলে বউ পেটানোর উপদ্রব বেড়ে যেত দ্বিগুণ-ত্রিগুণ। একদিন এমনি এক নির্যাতনের মুহূর্তে স্ত্রীদয়

ক্ষেপে গিয়ে প্রতিবাদ করতে বটি দিয়ে কুপিয়ে নির্মম রক্তারক্তির কান্ডটা করে ফেলে।

পড়তে পড়তে রেবিনার মনটা এক ধরনের অদ্ভুত আত্মতৃপ্তিতে ছেয়ে গেল। লম্বা করে শ্বাস নিতেই

বুকের পাঁজরগুলো ফুলে উঠল তার।

“কী রে? কী বুঝলি? নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ যে চারা গজিয়ে ডালপালা বিস্তার করছে বুঝতে

পারছিস? সেই দিন আর বেশি দূরে নেই, যখন নারীরা আরাম করে বালিশে হেলান দিয়ে বিছানায় শুয়ে

থাকবে, আর পুরুষেরা পায়ের কাছে বসে সুগন্ধি সাবান দিয়ে ধোয়া হাতে যতœ করে খাঁটি

সরিষার তেল মেখে নারীদের পা মালিশ করে দেবে, আঙ্গুল টেনে দেবে, আর এই টেপাটেপি টানাটানিতে

একটু ব্যাঘাত ঘটলেই নারীরা পুরুষদের কুংফু টাইপের লাথি মেরে বিছানার নিচে ফেলে দিয়ে বলবে

টিপতে গিয়ে খামচা লাগে কেন?”

“বুঝলাম, কিন্তু বেডাডারে বডি দিয়া কুপাইয়া মাইরা ফালানোর অপরাধে যদি বেডি দুইডার

ফাঁসি অয়?”

“ফাঁসি হবে কেন! ফাঁসি হবে কেন! দেশে কি আইন-কানুন বলতে কিছুই নেই? লোকটা অপরাধী

ছিল, বৌদের সে অমানবিক নির্যাতন করত। নির্যাতনের উপযুক্ত শাস্তি সে পেয়েছে। তাছাড়া

বাংলাদেশ তো আর মগের মুল্লুক নয়, বাংলাদেশী সরকার তো আর নির্বোধ নয়, তারা নারীদের মূল্য

বোঝে। তাইতো নারীদের জন্য সকল বিষয়ে অগ্রাধিকারের ব্যবস্থা করেছে।”

রেবিনা বলল, “আফামনি খবরডা পড়তে যেয়ে কী ভালা লাগতাছে! বারবার পড়তে ইচ্ছা করতাছে।

আফামণি আপনে যদি অনুমতি দেন আমি খবরডা চিক্কার পাইরা পড়ি। আপনে চোখ বন্ধ রাইখা আরাম

কইরা শুনেন।”

কাজের মেয়ের প্রস্তাবে শাহরিয়ার পারভীন হ্যা সূচক সায় দেওয়ায় মেয়েটা হালকা কেশে গলা পরিষ্কার

করে নিয়ে আবৃত্তি করার মতো সুরেলা উচ্চারণে বক্তৃতা দেওয়ার মতো সশব্দে পড়তে লাগলো।

পত্রিকায় এজাতীয় খবর প্রকাশিত হলে এই দুইজন যেমন আকাশছোঁয়া খুশি হয়, তেমনি নারী

নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ জাতীয় খবর ছাপা হলে পাতালস্পর্শী বেদনাহত হন। তাদের এই দুঃখ সুখের গড়

করলে দেখা যায় সুখের চেয়ে দুখের পরিমাণ অনেক বেশি।

রেবিনার সাথে শাহরিয়ার পারভীনের প্রথম পরিচয়টা আকস্মিক। শহরের প্রাণ কেন্দ্রে মহিলা সমিতির

উদ্যোগে আয়োজিত এক জনসভা থেকে বাসায় ফিরছিলেন পারভীন। তার ঘরের বারান্দায় একটা

আঠারো উনিশ বছর বয়সী মেয়েকে হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদতে দেখা গেল।

“এই মেয়ে। এখানে বসে কাঁদছো কেন? নাম কী তোমার? বাড়ি কোথায়? কী সমস্যা?”

মেয়েটা কাঁদো কাঁদো স্বরে শুধু নাম বলা ছাড়া অন্য কোন প্রশ্নের জবাব দিল না। পরবর্তীতে একে

একে জানা গেল সব। গ্রাম থেকে এসেছে। একটা ছেলেকে ভালোবাসত। তার হাত ধরেই বাড়ি থেকে

পালিয়ে এসেছিল সে। শহরের একটা হোটেলে দুদিন দু’রাত কাটানোর পর ছেলেটা কোথায় উধাও হয়ে

গেল। তৃতীয় দিন সকালবেলা হোটেল মালিক তাকে হোটেল থেকে জোরপূর্বক ধমকা ধমকি করে বের

করে দিলেন। এখন আর বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়। গ্রামবাসী অসতী-অপয়া বলে গালি দেবে। নোংরা ইঙ্গিত

দিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসবে। এখন উপায়! অবশেষে শাহরিয়ার পারভীন আশ্রয়দাতা হলেন। যে মহিলা

সারাবিশ্বের অবরুদ্ধ নারী জাতির মুক্তির পথপ্রদর্শক হতে যাচ্ছেন, সে মহিলা একটা অসহায় মেয়ের

সহায়দাতা হতে পারবেন না তা কি করে সম্ভব!

রেবিনা বলেছিল, “আপনে আমারে আত্মহত্যার হাত থেকে বাঁচাইছেন, নতুন জনম দিছেন। আপনে

আমার মায়ের মতন। আমি আপনেরে মা বলেই ডাকবাম।”

জবাবে শাহরিয়ার পারভীন বললেন, “একজন নারী মুক্তির আন্দোলনকারী হিসেবে এটাতো আমার দায়িত্ব।

তুমি আমাকে মা ডাকতে যাবে কেন! এই শহরের সবাই আমাকে আপামনি বলে ডাকে। তুমিও

আমাকে আপামনি ডাকবে।”

আপামনির এমন কোমল উত্তর শুনে রেবিনার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। সে অশ্রু আনন্দের।

গরিব ঘরের মেয়ে। কোনদিন স্কুলে যায়নি। অক্ষর জ্ঞান নেই। আপামনিই তাকে বর্ণমালা চিনিয়ে

দিলেন। একবার ভেবেছিলেন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবেন। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি। একটা আঠারো-

উনিশ বছরের মেয়ে শিশু স্কুলের বাচ্চাদের সাথে বসে ক্লাস করবে, দেখতে কেমন লজ্জা জনক দেখায়।

রেবিনা স্কুলে যায়নি সত্য, কিন্তু সে এখন পেপার ম্যাগাজিন হ্যান্ডবিল চোখ বন্ধ রেখেই গরগড় করে

পড়তে পারে। কঠিন শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। এমনকি দু-একটা ইংরেজি শব্দও নির্দ্বিধায় বলতে পারে।


রেবিনার সশব্দ সংবাদপত্র পাঠ শেষ হতেই শাহরিয়ার পারভীন বিপ্লবী বললেন, “সাহিত্য পাতাটা

দেখেছিস? সাহিত্য পাতায় চোখ গেলে তোর মাথা ঘুরে যাবে রে রেবিনা।”

রেবিনার মাথা সত্যিই ঘুরে গেল। বিস্ময়ে চোখ দুটা কপালে তুলে বলল, “আফামনি, আমি বলছিলাম

না আফনের লেহা ফেফারে ছাপা না হইয়া থাকতে পারে না। আফনে অত্ত জ্ঞানী মানুষ, আর আফনের হাতের

লেহা!”

রেবিনার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটাকে কেন্দ্র করে শাহরিয়ার পারভীন একটা গল্প লিখেছিলেন। সেই গল্প

ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। সত্যিই মজার ব্যাপার। গল্পটা যেমন বাস্তবধর্মী তেমনই লোমহর্ষকও বটে।

“আমার কী মনেহয় জানিস? বাংলাদেশের যে কয়টা মেয়ে এই গল্প পড়বে, গল্পের ভাববস্তু বুঝতে পারবে,

তারা আর যাই করুক, কোন ছেলের পাল্লায় পড়ে জীবনটাকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেবে না। আর মেয়েরা

যদি ছেলেদের লুলুপ ডাকে সারা না দেয়, তবে ছেলেরা প্রেম না পাওয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করে মরবে।”

“আফনে ঠিকই বলেছেন। পুলাগোর প্রেম না পাওয়ার যন্ত্রণায় পুইরা মরা উছিত। হেগুর বোঝা উচিত,

মাইয়া মানুষ অত সহজ বিষয় না। মাইয়া মানুষ ফেলন্তী জিনিস না।”

সপ্তাহের সাত দিনের মাঝে প্রায় সাত দিনে বর্ণন অযোগ্য ব্যস্ত থাকতে হয় শাহরিয়ার পারভীন

বিপ্লবীকে। বিপ্লবী উপাধিটা তো আর শুধু শুধুই পেয়ে যাননি তিনি। এর জন্য প্রচুর কাঠ কয়লা

পোড়াতে হয়েছে। মিছিল-মিটিং, জনসভা, নারী আন্দোলন করে করে জীবনের স্বর্ণখচিত

আটচল্লিশটা বছর চোখের আড়ালে আবডালে ধুলিস্যাৎ, অথচ স্বামী সংসার সন্তান কিছুই হলো না।

আটচল্লিশ বছর, সে কি সহজ কথা! এরই মাঝে সূর্যকে আটচল্লিশ বার প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী।

আটচল্লিশটা শীত বসন্ত বর্ষা এসে চলে গেছে। শুধু কি তাই! প্রায় সাড়ে পাঁচসতাধিক

পূর্ণিমা অমাবস্যা; এসব কি কেউ ফিরিয়ে দেবে? কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে তাকে? সেই পনেরো

বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন। তখন থেকে মা-ই তার একমাত্র নির্ভরযোগ্য অভিভাবক। ভাই বোন

কেউ নেই সংসারে। তেইশ বছর বয়সে অভিভাবকদের আপত্তি মেটাতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন।

সংসারের স্থায়িত্ব হলো মাত্র তিন মাস দশ দিন। স্বামীর মুখের উপর স্বাক্ষর করা তালাকনামা ছুড়ে মেরে

চলে এলেন। সংসার জীবন নাকি নারীর স্বাধীনতা কেড়ে নেয়! তার চাই স্বাধীনতা। শুধু নিজের

স্বাধীনতা পেলেই হলো না, সারা বিশ্বের সব কয়জন নারীকে স্বাধীন করতে হবে পুরুষ শাসিত সমাজের

শৃংখল থেকে। তাই শুরু করলেন নারী স্বাধীনতার আন্দোলন।

“রেবিনা, তোর মনে আছে গত দুসরা ডিসেম্বর তমাল তলা স্কুলের মাঠে যে ভাষণটা দিয়েছিলাম, সেই

ভাষণটার কথা?”

রেবিনা জানতে চাইলো, “কোন ভাষণটার কথা বলতেছেন আফামনি?”

“এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি! সেই যে প্রায় তিনশতাধিক প্রতিবাদী মহিলার সামনে মাইক ফাটিয়ে

বলেছিলাম নারীরাও মানুষ, পুরুষের মতই মানুষ। আল্লাহ পুরুষকে যতোটুকু শক্তি দিয়েছেন, ক্ষমতা

দিয়েছেন, অধিকার দিয়েছেন, নারীকেও ঠিক ততটুকু শক্তি দিয়েছেন, ক্ষমতা দিয়েছেন, অধিকার

দিয়েছেন। একটা ছেলে সন্তানকে আল্লাহতালা মাতৃগর্ভে দশ মাস দশ দিন রাখেন, একটা মেয়ে

সন্তানকেও দশ মাস দশ দিনেই রাখেন। একটা ছেলের জন্য মায়ের বুকে যতটুকু দুধ সৃষ্টি হয়, একটা

মেয়ের জন্য তার চেয়ে এক ফোটা দুধও কম সৃষ্টি হয় না। সুতরাং আল্লাহ যেহেতু একটা ছেলে ও

একটা মেয়ের মাঝে ব্যবধান করে দেখাননি, আমরা কেন ব্যবধান করব। আমার বক্তৃতা শুনে এত এত মহিলারা

কী করলো জানিস?”

রেবিনা বলল, “কী করলো আফামনি?”

আবেগাপ্লুত হয়ে সশব্দ করতালি দিয়ে আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে তুলল। আমি আবার বললাম, “আমরা

পুরুষ শাসিত সমাজে শোষণের শিকার। এই শোষণ থেকে রেহাই পাওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই হাতে।

আমরাই পারি আমাদের এই দুর্দশা থেকে মুক্ত হতে, আমাদের ভাগ্য ফেরাতে। আপনারা ভাগ্য ফেরাতে রাজি

আছেন? রাজি থাকলে হাত তুলুন। তখন কী হলো জানিস রেবিনা? সবাই উপরের দিকে হাত তুলতে

লাগলো। কেউ মুষ্টিবদ্ধ হাত, কেউ ইংরেজি ভি অক্ষরের মত তর্জনী ও মধ্যাঙ্গুলি খোলা হাত, কেউ

সম্পূর্ণ খোলা হাত, কেউ একটা হাত, কেউ দুইটা হাত। আমি বললাম, কাল পুরুষ বিরোধী মিছিল

হবে। সবাই আসবেন। ঝর বৃষ্টি রোদ উপেক্ষা করে আসবেন। প্রয়োজনে ছাতা মাথায় মিছিল দেব। তবু

মিছিলে আপনাদের মুখ দেখতে চাই। সাহসী হাত দেখতে চাই। পরদিন কী হলো জানিস?”

রেবিনা জবাব দিলো, “নিশ্চই সবাই দলবল লইয়া মিছিল দিবার আইছিল?” “ঠিক ধরেছিস। যদিও

মিছিল দিতে একেবারে সবাই আসেনি, তবু অনেক বড় একটা মিছিল হলো। পুরুষ বিরোধী মিছিল।

নারী মুক্তির ও অধিকার আদায়ের মিছিল। মিছিল শেষে সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া করলাম আর সবকয়জন


মিছিলকারীর হাতে সমিতির পক্ষ থেকে একটা করে একশো টাকার নোট তুলে দেওয়া হলো। এই নোট

তুলে দেওয়াতেই ঘটল সমস্যাটা। সমাজের বজ্জাত বেহায়া পুরুষেরা আমেরিকান কায়দায় স্বাগতম

জানানোর মতো বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বলাবলি শুরু করল আমরা নাকি টাকার বিনিময়ে মিছিলকারী কিনে

এনেছি। মহিলারা নাকি টাকার লোভে মিছিল দিতে এসেছিল।”

“বেডাইন মাইনষের হইলো এই দোষ, একটু সুযোগ পাইলেই মাইয়া মাইনষেরে ডুবাইয়া দেওয়ার

ফন্দি আডে, মুখপোড়ার দল। আফামনি, আফনের কী আইজগাও বাইরে কোনো মিটিং-মিছিল

আছে?”

“আছে রে... আছে। এই মিছিল-মিটিং আমাকে কোনদিন ছাড়বে না। বিকেলেই জনসভা। বক্তৃতা

দিতে হবে। ইদানিং ঘড়ির কাঁটা খুব দ্রুত ঘুরে। কখন যে সকাল দশটা বেজে গেল, বুঝতেই পারিনি।

শরীরটা কেমন যেন ম্যাজ ম্যাজ করছে। একটু মালিশ করে দিবি?”

শাহরিয়ার পারভীনের আদেশে রেবিনা আপামনির মাথা ঘাড় হাত পা টিপে দিল। আপামনি বললেন, “এই

মালিশ ব্যাপারটায় স্বর্গের সুখ। দরজা জানালা বন্ধ করে আয় তো। সর্বপ্রকার মালিশ দরজা জানালা

খোলা রেখে করা বিপদজনক; কেউ দেখে ফেললে লজ্জার ব্যাপার।”

রেবিনা দরজা জানালা বন্ধ করে আপামনির শরীর টেপতে যাবে, এমন সময় কলিং বেলটা মধুর শব্দে বেজে

উঠলো।

“এই অসময়ে আবার কে এলো দেখতো? যত্তসব।” - শাহরিয়ার পারভীন বললেন।

রেবিনা দরজা খুলে দেখল একজন মহিলা একটা বাচ্চা কুলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“আফামনি, একটা বেডি আফনের লগে দেহা করবার চায়।”

শাহরিয়ার পারভীন মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, “কী চাই? কী জন্য এলেন?”

মহিলাটি তার কুলের বাচ্চাটার দিকে ইশারা দিয়ে বলল, “পুলার বাপে এতদিন রিকশা চালাইতো। গত

শুক্রবারে ট্রাকের লগে এক্সিডেন্ট লাগাইয়া ঠ্যাং ভাইঙ্গা হাসপাতালে পইরা আছে। চিকিৎসা করতে

অনেক টেকার দরকার। আফামনি, আমি আফনেগোর মিছিল-মিটিং এ নিয়মিত উপস্থিত থাহি।

বাচ্চাডার দিকে চাইয়া আফনে যদি আমারে কয়ডা টেহা সাহায্য করতেন।”

অসহায় মহিলা ও তার কুলের শিশু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে শাহরিয়ার পারভীন বিপ্লবীর অসম্ভব মায়া

লাগলো। ড্রয়ার টেনে হাতের কাছে যে কয় টাকা পেলেন, তাই তুলে দিলেন মহিলার হাতে। মহিলা

আশীর্বাদ করতে করতে বলে গেল, “আফামনি আফনের এই উফকার আমি জীবনেও ভুলবার পারতাম না।

বাচ্চার বাপের ঠ্যাং ভালা হইলে রিক্সা চালাইয়া যা আনবো মনে হইবো হেইগুলাও আফনেরই দান।”

বিষয়টা নারী নেত্রী শাহরিয়ার পারভিন বিপ্লবীর কাছে খটকা লাগল। তিনি নারী হয়ে নারী মুক্তির লক্ষ্যে যে

পুরুষ জাতির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, অন্য একজন মহিলা নারী হয়ে সেই পুরুষ জাতির জন্য সাহায্য

মাগতে আসলো কেন! সন্দেহের জাল ছিন্ন করা উচিত। কাজের মেয়ে রেবিনা যখন দরজা জানালা বন্ধ

করে আপামনির শরীর মর্দন করে দিচ্ছিল, তিনি তখন পরম শান্তিতে চোখ বন্ধ রেখে রেবিনাকে জিজ্ঞেস

করলেন, “আচ্ছা, মনেকর কোন পুরুষ তোকে বিয়ে করতে চাইলো, তুই কি তার সাথে চলে যেতে রাজি

হবি?”

রেবিনা জবাব দিল, “আফামনি যেন কী কয়! একটা পুরুষ মানুষ ছাড়া একটা নারী মানুষের জীবনের

কোন মূল্য আছে! নারী হইল ফুল, আর পুরুষ মানুষ হইল সেই ফুলের ভ্রমরা। ভ্রমরা নাই, ফুলও নাই।”

ঠিক সেই মুহূর্তে শাহরিয়ার পারভীন বিপ্লবীর কেন যেন মনেহল সংসার জীবন না করে নারী

আন্দোলনের বিপ্লবী নেত্রী হয়ে তিনি নিজের জীবনটাকে যে হীরা বসানো সোনার আংটি ভেবে

গর্ববোধ করছেন, তা আদ্যপান্ত মিথ্যে ভ্রম। তার জীবনটা আসলে মেকি সোনার আবরণ দিয়ে ঢাকা

তামার আংটি।


Previous Post
Next Post

post written by:

0 Comments:

Note: Only a member of this blog may post a comment.